শিক্ষার্থীদের আল্টিমেটাম মালিক-বিআরটিএ চুপ

Passenger Voice    |    ০৯:১৩ এএম, ২০২১-১১-২৪


শিক্ষার্থীদের আল্টিমেটাম মালিক-বিআরটিএ চুপ

জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর বাড়ানো হয়েছে পরিবহন ভাড়াও। বাড়তি ভাড়া কার্যকরের পর থেকে মাঝেমধ্যেই পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছেন যাত্রীরা। বিশেষ করে হাফ ভাড়া নিয়ে এই দ্বন্দ্ব সবচেয়ে বেশি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। শিক্ষার্থীরা বাস ভাঙচুর করছেন, পরিবহন শ্রমিকরা শিক্ষার্থীদের পেটাচ্ছেন, দিচ্ছেন ধর্ষণের হুমকিও।

সর্বশেষ গতকাল মঙ্গলবার এই দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে ছাত্রলীগও। গতকাল সায়েন্স ল্যাব এলাকায় হাফ ভাড়া নিয়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে সংগঠনটির ঢাকা কলেজ শাখার নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। হামলার পর আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা অবরোধ তুলে নিলেও ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে তাদের হাফ ভাড়ার দাবি মেনে প্রজ্ঞাপন জারি করতে সরকারকে আলটিমেটাম দিয়েছে।  

গত ৭ নভেম্বর ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরের বাস ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ৭০ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২ টাকা ১৫ পয়সা করা হয়। দূরপাল্লার বাস ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ১ টাকা ৪২ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১ টাকা ৮০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়েছে। শিক্ষার্থীদের বক্তব্য, বাড়তি যে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে সেটি দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ প্রতিদিন তাদের ২০-৩০ টাকা বেশি ভাড়া দিতে হচ্ছে। তারা বলছেন, মাস শেষে তাদের একজন শিক্ষার্থীর জন্য প্রায় ৬০০-৭০০ টাকা বেশি ভাড়া দিতে হচ্ছে শুধু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাওয়া-আসার জন্য। এছাড়া শিক্ষার্থীদের আরেকটি অভিযোগ হলো সরকার যে ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে বাস-শ্রমিকরা তার চেয়ে বেশি ভাড়া আদায় করছে।

যা বহন করা শিক্ষার্থীদের পক্ষে সম্ভব নয়। আর এজন্যই বাস ভাড়া অর্ধেক কমানোর দাবি করেছেন তারা। ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে বাসে অর্ধেক ভাড়া দেওয়ার দাবিতে খণ্ড খণ্ড আন্দোলন করছেন তারা।

একসময় গণপরিবহনে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার প্রচলন থাকলেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আর সেই রীতি অনুসরণ করতে চাইছেন না বেশিরভাগ গণপরিবহন মালিকরা। সেই কথা মনে করিয়ে দিয়েই চলমান শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে সংহতি ও সমর্থন দিতে শুরু করেছে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন। সমর্থন আসছে খোদ আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের থেকেও। তারা নানান সময়ে নানান মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দাবিকে যৌক্তিক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। গতকালই হাফ ভাড়ার দাবিতে চলা আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করে তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসান বলেন, ‘চলমান আন্দোলন যৌক্তিক। ছাত্র-ছাত্রীদের ন্যায্য ও যৌক্তিক দাবিগুলো নিয়ে আমি সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্তদের সঙ্গে কথা বলব। ’

সড়কের নৈরাজ্য বন্ধ করে ছাত্রদের জন্য হাফ ভাড়া নিশ্চিত করতে হবে বলে দাবি জানিয়েছেন জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ও বিরোধীদলীয় উপনেতা জিএম কাদের। তিনি বলেছেন, ‘সড়কে পরিবহন শ্রমিকরা যাত্রীদের সঙ্গে যে আচরণ করছে তা মেনে নেওয়া যায় না। ডিজেল ও কেরোসিনের দাম বাড়ার অজুহাতে সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ বাস ভাড়া যতটুকু বাড়িয়েছে শ্রমিকরা যাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করছে তার চেয়েও বেশি। ’

বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতিও শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে সংহতি জানিয়েছে। সংগঠনের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘অর্ধেক ভাড়া শিক্ষার্থীদের দাবি নয়, বরং অধিকার। ’ সংগঠনটি প্রতিবন্ধী ও দাঁড়িয়ে চলাচলকারী যাত্রীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার দাবিও জানিয়েছে।

সংগঠনটির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, যাত্রী প্রতিনিধি না রেখে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্র্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তাদের ভুল বুঝিয়ে নানা খাতে অযৌক্তিক ও অতিরিক্ত ব্যয় দেখাচ্ছেন বাস মালিকরা। এভাবে একচেটিয়া ভাড়া বৃদ্ধি যাত্রীদের গলার কাঁটায় পরিণত হয়েছে। শিগগিরই এই বিষয়ে প্রজ্ঞাপন দেওয়ার দাবি জানান তিনি।

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসাইন বলেন, সরকার গণপরিবহন আইন সংশোধনসহ নানা উদ্যোগ গ্রহণ করলেও ভাড়া নৈরাজ্য বন্ধ হয়নি। তেলের দাম বৃদ্ধির অজুহাতে সরকার গণপরিবহনের ভাড়া পুনর্নির্ধারণ করলেও গণপরিবহনের মালিক-শ্রমিকরা সরকার নির্ধারিত ভাড়া আদায় না করে নিজেদের ইচ্ছামতো দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করছে।

১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবির মধ্যেও ছিল হাফ ভাড়ার বিষয়টি। সেই বিষয়টি মনে করিয়ে দিয়ে ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ (নিসচা)-এর প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন যাত্রীদের অধিকার নিয়েও কাজ করেন। ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, ‘পাকিস্তান আমলে আমরা হাফ ভাড়া দিতাম। তখন ঝগড়া হতো না। আইডি কার্ড দেখালেই হাফ ভাড়া নিত। তখন ছাত্র বললেই হাফ ভাড়া হতো। ’

এ বিষয়ে গতকাল সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের সঙ্গে এক মতবিনিময় অনুষ্ঠানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম বলেন, ‘হাফ ভাড়ার দাবি তো যৌক্তিক। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন এয়ারে ১১৫ টাকা ভাড়ায় ঢাকা থেকে করাচি গিয়েছি। বাসেও হাফ ভাড়া দিয়েছি। ’

২০১৮ সালের নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের ৯ দফা দাবিরও একটি ছিল হাফ ভাড়া। তখন শিক্ষার্থীদের দাবি ছিল, ‘শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশের শিক্ষার্থীদের জন্য হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ’ ওই বছর নতুন সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়ন হলেও সেখানে অজ্ঞাত কারণে অর্ধেক ভাড়াসংক্রান্ত দাবি উপেক্ষা করা হয়েছে। এপর এবার যখন বাস ভাড়া নির্ধারণের দায়িত্বে থাকা বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্র্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) পরিবহন মালিকদের সঙ্গে বৈঠক করে ভাড়া বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিল তখনো শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়ার বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। যদিও সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একাধিকার শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন।  

তবে এবারের আন্দোলনকালে এখনো বিষয়টি নিয়ে তেমন কোনো মন্তব্য করেননি। পরিবহন মালিকদের সঙ্গেও তার কোনো বৈঠক হয়নি তার। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি সাংসদ মশিউর রহমান রাঙ্গা জানান, ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে তাদের এ নিয়ে কোনো আলোচনা হয়নি। তবে বিআরটিসি চাইলেই অর্ধেক ভাড়া চালু করতে পারে বলেও মত দেন রাঙ্গা। এ জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে উল্লেখ করে মশিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, বিষয়টি সরকারের বিষয়। আমাদের নয়। আমাদের না বললে যেচে গিয়ে সরকারের সঙ্গে বসব না। সরকার বলুক। ’

হাফ ভাড়া নিশ্চিতের দাবিতে ও শিক্ষার্থীদের হেনস্তার প্রতিবাদে গতকাল মঙ্গলবারও রাস্তায় নেমেছেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। এ সময় আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার অভিযোগ উঠেছে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে। পরে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকা কলেজের ছাত্রদের সঙ্গে আইডিয়াল কলেজের ছাত্রদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে।

পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী গত দুপুরে হাফ ভাড়ার দাবিতে রাজধানীর সায়েন্স ল্যাব মোড় অবরোধ করেন ঢাকা কলেজ, আইডিয়াল কলেজ, সিটি কলেজ, মুন্সি আব্দুর রউফ কলেজসহ আশপাশের কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা।

আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা বলেন, আমরা শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করছিলাম। একপর্যায়ে সায়েন্স ল্যাব মোড় থেকে নীলক্ষেতের দিকে রওনা হলে ঢাকা কলেজের সামনের তেলের পাম্পের সামনে অবস্থান নিই। সে সময় একজন লোক এসে আমাদের রাস্তা ছেড়ে দিতে বলেন। তিনি নিজেকে ঢাকা কলেজ শাখা ছাত্রলীগের নেতা দাবি করেন।

একপর্যায়ে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা তার সঙ্গে বাগ্বিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। পরে আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীর হাতে হেনস্তার শিকার হন তিনি।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছাত্রলীগ নেতা দাবি করা শিক্ষার্থীর নাম খায়রুল হাসু। তিনি ঢাকা কলেজ শহীদ ফরদান হোসেন ছাত্রাবাসে থাকেন। খায়রুল হাসু বলেন, ‘আমি শুধু বলেছি অ্যাম্বুলেন্স ছেড়ে দিতে। ওরা সবাই জড়ো হয়ে আমার ওপর হামলা করে। আমার বাইক ভেঙে ফেলে, টি-শার্ট ছিঁড়ে ফেলে। আমার মোটরসাইকেল ভাঙচুর করে। পরে ঢাকা কলেজের ৪০-৫০ জন ছাত্রলীগ কর্মী আন্দোলনে থাকা শিক্ষার্থীদের ধাওয়া দেয়। ’

এ বিষয়ে নিউমার্কেট জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) শাহেন শাহ্ বলেন, অন্যদিনের মতো শিক্ষার্থীদের শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি ছিল। তারা আন্দোলন শেষ করে নীলক্ষেত মোড়ের দিকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে যাচ্ছিল। পরে ঢাকা কলেজের সামনের পাম্পে আইডিয়াল কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কী হয়েছে সেটা আমরা সরাসরি দেখিনি।

 

সূত্রঃ দেশ রূপান্তর